শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ০৯:২৭ অপরাহ্ন

করোনাভাইরাস : ‘জনতা কারফিউয়ে’ স্তব্ধ গোটা ভারত

করোনাভাইরাস : ‘জনতা কারফিউয়ে’ স্তব্ধ গোটা ভারত

স্বদেশ ডেস্ক:

ভারতের রাজধানী দিল্লির প্রাণকেন্দ্র সদাব্যস্ত কনট প্লেসে রোববার সকাল থেকে কোনো জনপ্রাণীর দেখা নেই। সারি সারি দোকানের শাটার নামানো, মেট্রো স্টেশনের কলাপসিবল গেটে বিশাল তালা ঝুলছে। পালিকা বাজার, সরোজিনী নগর মার্কেট বা লাজপত নগরও জনশূন্য। যে পার্কিং লটে জায়গা পেতে রোজ নাভিশ্বাস ওঠে, সেটা একদম খালি। রিং রোডে পর্যন্ত গাড়ির দেখা নেই, চাইলে সেখানে ক্রিকেট ব্যাট-বল নিয়ে নেমে পড়া যাবে – এতটাই ফাঁকা দিল্লির প্রধান আর্টারিয়াল রোড।

আর শুধু রাজধানীতে নয়, গোটা ভারতের নানা প্রান্তে মোটামুটি এই একই ধরনের ছবি। ১৩০ কোটিরও বেশি জনসংখ্যার একটা দেশে সব মানুষকে যেন রাস্তাঘাট থেকে বেমালুম সরিয়ে দেয়া হয়েছে, মুছে ফেলা হয়েছে স্বাভাবিক জনজীবনের প্রতিটি ছোটখাটো চিহ্ন।

বিধ্বংসী করোনাভাইরাসের মোকাবেলায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আহ্বানে এভাবেই আজ ‘জনতা কারফিউ’ পালন করছে সারা ভারত। ভারতীয়দের রোববার সকাল সাতটা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত টানা চোদ্দ ঘণ্টা কঠোরভাবে বাড়ির ভেতরে থাকার নির্দেশ দিয়েছেন মোদি। আর স্বেচ্ছা গৃহবন্দিত্বের এই সময়কালটুকু বর্ণনা করতে তিনি নিজেই চয়ন করেছেন এই ‘জনতা কারফিউ’ শব্দটি।

অত্যাবশ্যকীয় বিভাগের সেবাকর্মীরা ছাড়া কেউ যেন এই কারফিউ-র মধ্যে বাইরে না-বেরোয়, মোদি পইপই করে সেটা নিষেধ করেছেন। শুধু তা-ই নয়, রোববার ঠিক বিকেল পাঁচটায় নিজেদের বাড়ির দরজা বা জানালার সামনে এসে কিংবা ব্যালকনিতে বেরিয়ে সজোরে হাততালি দিয়ে, শঙ্খনাদ করে, দরকারে থালা-বাসন বাজিয়ে সম্মিলিতভাবে কলতান সৃষ্টিরও অনুরোধ করেছেন তিনি।

করোনাভাইরাস সঙ্কট সামলানোর চেষ্টায় যে স্বাস্থ্যকর্মীরা ও আপৎকালীন পরিষেবা বিভাগের লোকজন নিরলস পরিশ্রম করে চলেছেন, তাদের সারা দেশের পক্ষ থেকে অভিবাদন ও কৃতজ্ঞতা জানাতেই এই সমবেত করতালি আর শঙ্খনাদের আয়োজন।

অনেকে বলছেন, স্পেনে যেভাবে সম্প্রতি জরুরি বিভাগের কর্মীদের সারা দেশ একটা নির্দিষ্ট সময়ে হাততালি দিয়ে অভিনন্দন জানিয়েছে – ঠিক সেটার অনুকরণেই ভারতেও প্রধানমন্ত্রী মোদি এই পদক্ষেপ নিয়েছেন। চোদ্দ ঘণ্টার ‘জনতা কারফিউ’ করোনাভাইরাস ছড়ানো রোখার ক্ষেত্রে ‘চেইন’-টা ভাঙতে পারবে কি না, তা নিয়েও ভারতে শুরু হয়েছে তর্কবিতর্ক। কেউ কেউ বলছেন, এটা একটা দারুণ পদক্ষেপ – আবার কারো মতে এত অল্প সময়ে আসলে তেমন কিছুই হবে না।

সোশ্যাল মিডিয়াতে অনেকেই আবার মন্তব্য করছেন, ভারত অবধারিতভাবে একটা সম্পূর্ণ লকডাউনের দিকে এগোচ্ছে – তার আগে আজ রোববারের এই জনতা কারফিউ আসলে একটা মহড়া বা ‘ড্রেস রিহার্সাল’!

তবে এটা ঠিক, ‘সামাজিক দূরত্ব’ (সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং) বজায় রাখার প্রশ্নে কিংবা নিজেকে ঘরে আটকে রাখার প্রশ্নে মাত্র কদিন আগেও ভারতজুড়ে যে এক ধরনের গা-ছাড়া মনোভাব দেখা যাচ্ছিল, আজকের জনতা কারফিউ সেই মানসিকতাকে সমূলে আঘাত করেছে।

একান্ত প্রয়োজন ছাড়া দেশের ভেতরেও এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় সফর করার যে কোনো দরকার নেই – সরকার সেটা বেশ কড়া বার্তা দিয়ে দেশবাসীকে বুঝিয়ে দিয়েছে। সারা ভারতের ‘লাইফলাইন’ বলে ধরা হয় যে ভারতীয় রেলকে, তারাও আজ জনতা কারফিউ-র দিনে কোনো যাত্রীবাহী ট্রেন চালাচ্ছে না। শুধু যে দূরপাল্লার ট্রেনগুলো শনিবার রওনা দিয়েছে, সেগুলো চলছে – তবে মাঝের কোনো স্টেশনে যাত্রাবিরতি ছাড়াই।

ওদিকে ইন্ডিগো, গো-এয়ার, ভিস্তারার মতো ভারতীয় এয়ারলাইনগুলো সারাদিনের বহু ফ্লাইট বাতিল করেছে। দিল্লি বা ব্যাঙ্গালোরের মতো শহরে থেমে গেছে মেট্রো রেলের চাকাও। বড় বড় মেট্রো শহরের বহুতল আবাসনগুলোতেও লাখ লাখ মানুষ স্বেচ্ছায় নিজেদের ঘরের ভেতর আটকা পড়ে আছেন। সব সময় গম গম করা এই সোসাইটিগুলোতে আজ অদ্ভুত নিস্তব্ধতা – দোকানপাট বন্ধ, পার্কে পর্যন্ত বাচ্চারা খেলছে না।

দিল্লির উপকণ্ঠে একটি বহুতল আবাসিক সোসাইটির বৃদ্ধ-বৃদ্ধারাও রোববার কেউ প্রাতঃভ্রমণে বেরোননি। নয়ডা থেকে দিল্লিগামী সদাব্যস্ত রাস্তায় সকাল থেকে সাকুল্যে দশটা গাড়ি দেখা গেছে কি না সন্দেহ। এই সব অ্যাপার্টমেন্টে যারা গৃহপরিচারিকার কাজ করেন বা রান্নাবান্না করেন, তাদেরও সবার আজ অঘোষিত ছুটি। সকালে খবরের কাগজ বা দুধের প্যাকেটও বিলি করা হয়েছে ভোরের আলো ফোটার অনেক আগেই। কিন্তু এই সব আয়োজন কি মাত্র এক দিনের জন্য, না কি আগামীতে এরকম আরও প্রলম্বিত ‘জনতা কারফিউ’-র জন্য মানুষকে প্রস্তুত থাকতে হবে, ভারত তা এখনও ঠাহর করে উঠতে পারছে না।

এদিকে জনতা কারফিউ আর তাতে হাততালি বাজানোর ডাক নিয়ে রাজনৈতিক বাগবিতন্ডাও থেমে নেই। শাসক দল বিজেপি ও তার সমর্থকরা যথারীতি মোদির পদক্ষেপকে অকুণ্ঠ সমর্থন জানাচ্ছেন। ওদিকে বিরোধী দল কংগ্রেসের নেতা রাহুল গান্ধী আবার টুইটে কটাক্ষ করেছেন, ‘দেশের ছোট ও মাঝারি ব্যবসাগুলো এবং দিনমজুররা প্রবল সঙ্কটে আছেন – শুধু তালি বাজালে তাদের কোনো লাভ হবে না!’

পাশাপাশি নরেন্দ্র মোদির প্রবল বিরোধী ও সমালোচক বলে পরিচিত, অভিনেত্রী ও অ্যাক্টিভিস্ট শাবানা আজমি কিন্তু প্রকাশ্যেই বলেছেন, জনতা কারফিউ মোদির একটি ‘মাস্টারস্ট্রোক’।

দিল্লির শাহীনবাগে গত একশো দিন ধরে বিতর্কিত নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন যে মুসলিম নারীরা, তারা অবশ্য এই ব্যাখ্যা মানছেন না – জনতা কারফিউ-র ডাক অগ্রাহ্য করে তারা আজও তাদের অবস্থান অব্যাহত রেখেছেন, যদিও অনেক সংক্ষিপ্ত আকারে।

তাদের কেউ কেউ মিডিয়া কর্মীদের বলেছেন,‘আমরা ডিটেনশন সেন্টারকে আসলে যে কোনো রোগের চেয়েও বেশি ভয় করি, তাই এই আইন তুলে না-নেয়া পর্যন্ত আমাদের প্রতিবাদ চলবে।’

শাহীনবাগের একটু দূরে জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়ার বর্তমান ও সাবেক ছাত্রছাত্রীরাও নাগরিকত্ব আইন ও এনআরসি-র বিরুদ্ধে লাগাতার প্রতিবাদ জানাচ্ছিলেন, কিন্তু রোববার জনতা কারফিউর দিনে তারা সেই আন্দোলন সাময়িকভাবে প্রত্যাহার করেছেন। সূত্র : বিবিসি

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877